চট্টগ্রাম ০৮:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১৮০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে নিজের কাছেই ৭২১ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান যে প্রবাসী

Listen to this article

বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনুন, সেটাকে রেমিট্যান্স হিসেবে দেখান, আর দিয়ে দিন কর ফাঁকি—খুবই সহজ? মোটেও না। তবে এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এ কৌশলে ১৮০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছেন। এ পরিমাণ সত্যিই বিস্ময়কর। এত টাকা দিয়ে ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিকের জন্য এক মাসের সরকারি বার্ধক্য ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব।

এ তথ্য কোনো অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে আসেনি, বরং সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে উঠে এসেছে। গত সোমবার (১৭ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, কীভাবে এক ব্যবসায়ী চীন থেকে ৭৩০ কোটি টাকা (প্রকৃতপক্ষে ৭২১ কোটি টাকা) ব্যক্তিগত রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এনেছেন।

এ কাজে কৌশল কী? কর ছাড়ের সুবিধা নিতে এ অর্থকে বৈদেশিক আয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটি সমস্যা রয়ে গেছে—রেমিট্যান্স করমুক্ত হলেও শর্ত হলো, প্রেরককে বিদেশে সেই অর্থ উপার্জন করতে হবে।

তবে সংশ্লিষ্ট ওই ব্যবসায়ী বাংলাদেশেই বসবাস করছিলেন, অথচ দাবি করেন, তিনি বিদেশ থেকে পরামর্শ ফি বাবদ এটি উপার্জন করেছেন। এনবিআরের কর গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে জানতে পারে, তিনি স্থানীয়ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন, অথচ তার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে।

এ তদন্ত সম্পর্কে অবগত এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সহযোগিতা ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না।’ তার মতে, কর অফিসের ভেতরে যোগসাজশের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘এটি নীতিগত অপব্যবহারের একটি ক্লাসিক উদাহরণ।’

এ ব্যবসায়ী কে?
এ কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম ফারুকী হাসান। প্রতীক গ্রুপ সিরামিক, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য এবং জ্বালানি খাতে সক্রিয় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিকভাবে সুসংযুক্ত ফারুকী একসময় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি থানা ইউনিটের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বাংলাদেশে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই ফারুকী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে, এবং তার ফোনও বন্ধ রয়েছে।

এনবিআর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ৬৭ বছর বয়সি ফারুকী চীনের নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এবং চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পেয়েছেন। কর্মকর্তারা জানান, তারা এর আগে কখনও এমন কর ফাঁকির কৌশল দেখেননি।

ফারুকী বৈদেশিক আয়ের যথাযথ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি কর অব্যাহতির শর্ত লঙ্ঘন করেছেন, যার ফলে তাকে কর পরিশোধ করতেই হবে।

কর বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করেছেন, পরামর্শ ফি যদি দেশে আনা হয়, তবে সেটি করমুক্ত নয়। সাধারণত ব্যাংকগুলো শুরুতে ১০ শতাংশ কর কাটে, এবং অতিরিক্ত কর প্রয়োজনে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আরোপ করা হয়।

এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই তাকে ২৫ শতাংশ কর পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছি। পাশাপাশি সাউথইস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, ‘জব্দকৃত অ্যাকাউন্টগুলোতে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ রয়েছে।’

এনবিআর-এর এ কর্মকর্তা সন্দেহ করছেন, এ অর্থ হয়তো পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আত্মসাৎ করা তহবিল অথবা চীনের সঙ্গে হওয়া কোনো চুক্তির মাধ্যমে বেআইনিভাবে আদান-প্রদান করা অর্থ হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘এমনও সন্দেহ রয়েছে যে, সাবেক সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা এ তহবিল থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার নামও উঠে এসেছে।’

কীভাবে এটি সম্ভব হলো?
নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ফারুকী দেশে ৭২১ কোটি টাকা এনেছেন, যা থেকে ১৮০ কোটি টাকা কর পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে এ বিপুল অর্থের কোনো করই পরিশোধ করা হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ২৬৯ কোটি টাকা দেশে এনেছেন। পরবর্তী দুই বছরে তিনি যথাক্রমে ৭৭ কোটি ও ৮১ কোটি টাকা স্থানান্তর করেন, যা রেমিট্যান্স ছাড়ের সুবিধার আওতায় পড়ে। এর আগে চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।

এনবিআরের রেকর্ড অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছর এবং তার আগের চার বছরের কর দাখিল নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়ায় বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়। তবে সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা তিনজন কর্মকর্তা কর প্রযোজ্য নয় বলে রায় দেন।

ফারুকী ঢাকার কর অঞ্চল-৫-এর অধীনে নিবন্ধিত ছিলেন, যেখানে তৎকালীন কমিশনার ছিলেন আবু সাঈদ মো. মুশতাক, যিনি বর্তমানে এনবিআরের সদস্য। একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

একজন সাবেক উপ-কর কমিশনার জানান, চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স করমুক্ত মর্যাদা পেয়েছে। ‘যেহেতু ব্যাংক বিদেশি রেমিট্যান্সের ওপর কর ধার্য করেনি, আমরাও কর আরোপ করিনি,’ বলেন তিনি। ‘আইন অনুযায়ী, বিদেশে উপার্জিত আয় রেমিট্যান্স হিসেবে এলে তা করমুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়—এমনকি যদি ব্যক্তি বাংলাদেশেও অবস্থান করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি শুধুমাত্র আমার সিদ্ধান্ত ছিল না; ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছিল।’ এনবিআরের সাবেক কর-নীতি সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম টিবিএসকে বলেন, ‘এ অর্থের ওপর কর ধার্য করা উচিত ছিল। কেন তা করা হয়নি, সেটি স্পষ্ট নয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর কর্মকর্তা জানান, ‘প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপ কর্মকর্তাদের ওপর ছিল। এখন দায়ীদের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।’

কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, ‘কেবল আইটি খাতের আয় ব্যতীত বাংলাদেশে বসবাসের সময় বিদেশে উপার্জিত পরামর্শ ফি করযোগ্য।’

ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ ধরনের লেনদেন অনুমোদনে ব্যাংক ও কর্মকর্তাদের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

‘সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) দাখিল করা উচিত ছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো প্রয়োজন ছিল। তা না হলে, এ অর্থ কীভাবে লেনদেন সম্পন্ন হলো?’ তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি সন্দেহ করেন, এটি শুধু ব্যাংকিং তদারকির ব্যর্থতা নয়, বরং সম্ভবত একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অনুমান করেন, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব এতে ভূমিকা রাখতে পারে।

‘একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। দায়ীদের আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে,’ বলেন তিনি।

এরকম আরও অনিয়ম আছে কি?
সরকার রেমিট্যান্স, পোল্ট্রি, মৎস্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও রপ্তানি খাতসহ একাধিক ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধুমাত্র রেমিট্যান্সের জন্য ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল, যেখানে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতের জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকার মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতকে সহায়তা করতে কর হার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এ সুবিধাগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিছু ব্যবসা আদতে রপ্তানি না করেও রপ্তানি প্রণোদনা সংগ্রহ করেছেন।

এছাড়া, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি কর ছাড়ের সুযোগ নিতে মৎস্য খাতের আয় ঘোষণা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যা মূলত কালো টাকা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বুধবার গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে কর সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে,’ যা এনবিআর-এর এসব খাতে কর ছাড় কমানোর ইঙ্গিত দেয়।

তবে, জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে প্রকৃত রেমিট্যান্স প্রেরকদের কর সুবিধা প্রত্যাহার করা অন্যায্য হবে।’

প্রতিবেদন: টিবিএস বাংলা

১৮০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে নিজের কাছেই ৭২১ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান যে প্রবাসী

আপডেট সময় ১২:৪০:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
Listen to this article

বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনুন, সেটাকে রেমিট্যান্স হিসেবে দেখান, আর দিয়ে দিন কর ফাঁকি—খুবই সহজ? মোটেও না। তবে এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এ কৌশলে ১৮০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছেন। এ পরিমাণ সত্যিই বিস্ময়কর। এত টাকা দিয়ে ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিকের জন্য এক মাসের সরকারি বার্ধক্য ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব।

এ তথ্য কোনো অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে আসেনি, বরং সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে উঠে এসেছে। গত সোমবার (১৭ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, কীভাবে এক ব্যবসায়ী চীন থেকে ৭৩০ কোটি টাকা (প্রকৃতপক্ষে ৭২১ কোটি টাকা) ব্যক্তিগত রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এনেছেন।

এ কাজে কৌশল কী? কর ছাড়ের সুবিধা নিতে এ অর্থকে বৈদেশিক আয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটি সমস্যা রয়ে গেছে—রেমিট্যান্স করমুক্ত হলেও শর্ত হলো, প্রেরককে বিদেশে সেই অর্থ উপার্জন করতে হবে।

তবে সংশ্লিষ্ট ওই ব্যবসায়ী বাংলাদেশেই বসবাস করছিলেন, অথচ দাবি করেন, তিনি বিদেশ থেকে পরামর্শ ফি বাবদ এটি উপার্জন করেছেন। এনবিআরের কর গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে জানতে পারে, তিনি স্থানীয়ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন, অথচ তার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে।

এ তদন্ত সম্পর্কে অবগত এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সহযোগিতা ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না।’ তার মতে, কর অফিসের ভেতরে যোগসাজশের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘এটি নীতিগত অপব্যবহারের একটি ক্লাসিক উদাহরণ।’

এ ব্যবসায়ী কে?
এ কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম ফারুকী হাসান। প্রতীক গ্রুপ সিরামিক, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য এবং জ্বালানি খাতে সক্রিয় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিকভাবে সুসংযুক্ত ফারুকী একসময় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি থানা ইউনিটের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বাংলাদেশে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই ফারুকী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে, এবং তার ফোনও বন্ধ রয়েছে।

এনবিআর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ৬৭ বছর বয়সি ফারুকী চীনের নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এবং চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পেয়েছেন। কর্মকর্তারা জানান, তারা এর আগে কখনও এমন কর ফাঁকির কৌশল দেখেননি।

ফারুকী বৈদেশিক আয়ের যথাযথ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি কর অব্যাহতির শর্ত লঙ্ঘন করেছেন, যার ফলে তাকে কর পরিশোধ করতেই হবে।

কর বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করেছেন, পরামর্শ ফি যদি দেশে আনা হয়, তবে সেটি করমুক্ত নয়। সাধারণত ব্যাংকগুলো শুরুতে ১০ শতাংশ কর কাটে, এবং অতিরিক্ত কর প্রয়োজনে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আরোপ করা হয়।

এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই তাকে ২৫ শতাংশ কর পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছি। পাশাপাশি সাউথইস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, ‘জব্দকৃত অ্যাকাউন্টগুলোতে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ রয়েছে।’

এনবিআর-এর এ কর্মকর্তা সন্দেহ করছেন, এ অর্থ হয়তো পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আত্মসাৎ করা তহবিল অথবা চীনের সঙ্গে হওয়া কোনো চুক্তির মাধ্যমে বেআইনিভাবে আদান-প্রদান করা অর্থ হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘এমনও সন্দেহ রয়েছে যে, সাবেক সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা এ তহবিল থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার নামও উঠে এসেছে।’

কীভাবে এটি সম্ভব হলো?
নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ফারুকী দেশে ৭২১ কোটি টাকা এনেছেন, যা থেকে ১৮০ কোটি টাকা কর পরিশোধ করার কথা ছিল। তবে এ বিপুল অর্থের কোনো করই পরিশোধ করা হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ২৬৯ কোটি টাকা দেশে এনেছেন। পরবর্তী দুই বছরে তিনি যথাক্রমে ৭৭ কোটি ও ৮১ কোটি টাকা স্থানান্তর করেন, যা রেমিট্যান্স ছাড়ের সুবিধার আওতায় পড়ে। এর আগে চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।

এনবিআরের রেকর্ড অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছর এবং তার আগের চার বছরের কর দাখিল নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়ায় বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়। তবে সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা তিনজন কর্মকর্তা কর প্রযোজ্য নয় বলে রায় দেন।

ফারুকী ঢাকার কর অঞ্চল-৫-এর অধীনে নিবন্ধিত ছিলেন, যেখানে তৎকালীন কমিশনার ছিলেন আবু সাঈদ মো. মুশতাক, যিনি বর্তমানে এনবিআরের সদস্য। একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

একজন সাবেক উপ-কর কমিশনার জানান, চার বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স করমুক্ত মর্যাদা পেয়েছে। ‘যেহেতু ব্যাংক বিদেশি রেমিট্যান্সের ওপর কর ধার্য করেনি, আমরাও কর আরোপ করিনি,’ বলেন তিনি। ‘আইন অনুযায়ী, বিদেশে উপার্জিত আয় রেমিট্যান্স হিসেবে এলে তা করমুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়—এমনকি যদি ব্যক্তি বাংলাদেশেও অবস্থান করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি শুধুমাত্র আমার সিদ্ধান্ত ছিল না; ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছিল।’ এনবিআরের সাবেক কর-নীতি সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম টিবিএসকে বলেন, ‘এ অর্থের ওপর কর ধার্য করা উচিত ছিল। কেন তা করা হয়নি, সেটি স্পষ্ট নয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর কর্মকর্তা জানান, ‘প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপ কর্মকর্তাদের ওপর ছিল। এখন দায়ীদের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।’

কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, ‘কেবল আইটি খাতের আয় ব্যতীত বাংলাদেশে বসবাসের সময় বিদেশে উপার্জিত পরামর্শ ফি করযোগ্য।’

ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ ধরনের লেনদেন অনুমোদনে ব্যাংক ও কর্মকর্তাদের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

‘সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) দাখিল করা উচিত ছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো প্রয়োজন ছিল। তা না হলে, এ অর্থ কীভাবে লেনদেন সম্পন্ন হলো?’ তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি সন্দেহ করেন, এটি শুধু ব্যাংকিং তদারকির ব্যর্থতা নয়, বরং সম্ভবত একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অনুমান করেন, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব এতে ভূমিকা রাখতে পারে।

‘একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। দায়ীদের আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে,’ বলেন তিনি।

এরকম আরও অনিয়ম আছে কি?
সরকার রেমিট্যান্স, পোল্ট্রি, মৎস্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও রপ্তানি খাতসহ একাধিক ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধুমাত্র রেমিট্যান্সের জন্য ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল, যেখানে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতের জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকার মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতকে সহায়তা করতে কর হার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এ সুবিধাগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিছু ব্যবসা আদতে রপ্তানি না করেও রপ্তানি প্রণোদনা সংগ্রহ করেছেন।

এছাড়া, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি কর ছাড়ের সুযোগ নিতে মৎস্য খাতের আয় ঘোষণা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যা মূলত কালো টাকা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বুধবার গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে কর সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে,’ যা এনবিআর-এর এসব খাতে কর ছাড় কমানোর ইঙ্গিত দেয়।

তবে, জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে প্রকৃত রেমিট্যান্স প্রেরকদের কর সুবিধা প্রত্যাহার করা অন্যায্য হবে।’

প্রতিবেদন: টিবিএস বাংলা