পটপরিবর্তনের পর যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ভ্রাতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেছেন, আপনাদের মাধ্যমে ছাত্র-যুবকসহ দেশবাসীর কাছে আহ্বান রাখতে চাই, আসুন প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নয়, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বে মাধ্যমে আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটি বাসযোগ্য উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করি। বৃহস্পতিবার দুপুরে দলের বর্ধিত সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ আজ এক ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে। এখনো ফ্যাসিস্টদের দোসররা এবং বাংলাদেশের শত্রুরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
যুক্তরাজ্যে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন খালেদা জিয়া। গত ৭ জানুয়ারি কুয়েতের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর তাকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জনগণকে সম্পৃক্ত করে ‘ঐক্যবদ্ধ বিএনপি’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমি যুক্তরাজ্য থেকে অসুস্থ অবস্থায় আপনাদের আহ্বান জানাতে চাই, আসুন জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে পূর্বের ন্যায় আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্ব প্রদানে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহতভাবে গড়ে তুলি।
বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে পরামর্শ রেখে খালেদা বলেন, ইস্পাত কঠিনে ঐক্যের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। আসুন, আমরা আগামী দিনগুলোতে শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের আধুনিক সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি এবং এতো ত্যাগের বিনিময় এই অর্জনকে সুসংহত এবং ঐক্যকে আরও বেগবান করি।
বিএনপিপ্রধান বলেন, দীর্ঘ ৬ বছর পর নেতৃবৃন্দ আবার একসাথে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে একত্রিত হয়েছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী বিরোধী সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছে এবং সম্প্রতি জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্মম ভয়াবহ দমননীতির কারণে গণহত্যায় যারা শহীদ হয়েছে তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা।
আমি চিকিৎসার কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও আমি সব সময় আপনাদের পাশেই আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য, আমার মুক্তির জন্য আপনারা যে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন এবং আমাদের অসংখ্য সহকর্মী প্রাণ দিয়েছে, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং প্রায় সোয়া লক্ষ মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন- এখনো তারা আদালতের বারান্দায় ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনাদের শুধু দল নয়, জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে।
‘নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ কাজ করুন’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, দেশ আজ এক সংকট সময় অতিক্রম করছে। আপনাদের এবং ছাত্রদের সমন্বিত আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট শাসকেরা বিদায় নিয়েছে। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা- রাষ্ট্র মেরামতের ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা।
নেতাকর্মীদৈর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং আপনাদের সকলকে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে দলকে সুসংহত করেছেন, এজন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।
এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে আপনাদের এতো দিনকার সংগ্রাম আত্মত্যাগ বিফলে যায়। আমাদের সবসময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই উক্তি মনে রাখা দরকার- ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’।
সকাল ১১টায় সংসদ ভবনের এলডি হলের মাঠে বিএনপির এই বর্ধিত সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, লন্ডন থেকে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। সারাদেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের সাড়ে ৩ হাজার নেতা এই বর্ধিত সভায় অংশ নিচ্ছেন।
খালেদা জিয়া যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন পাশে বসে ছিলেন তারেক রহমান। দলের চেয়ারপারসনের বক্তব্যের সময়ে নেতাকর্মীদের পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাদের নেত্রীর কথা শুনতে দেখা যায়। খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেওয়ার আগে প্রধান অতিথি হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য রাখেন।
তিনি দলের চেয়ারপারসনের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “বিএনপির সর্বশেষ বর্ধিত সভা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বেগম খালেদা জিয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনকালে এরপর আর বিএনপির বর্ধিতসভা বা কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসাধীন থাকার সময় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। তবে এই সভার সাফল্য কামনা করেছেন। তিনি আপনাদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। দেশনেত্রী শারীরিক সুস্থতার জন্য আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া কামনা করছি।
বর্ধিত সভার জন্য এলডি ভবনের সামনের মাঠে স্টিল অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সুসজ্জিত প্যান্ডেল। সভার মূল মঞ্চে আছেন বিএনপির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
মঞ্চের এক পাশে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিকৃতি রয়েছে। সভার সঞ্চালনায় আছেন যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও কোষাধ্যক্ষ রসিদুজ্জামান মিল্লাত।