গাজার অবশিষ্টাংশ থেকে রাফাকে বিচ্ছিন্ন করতে পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রাফা ও খান ইউনিসের বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাহিনী। এরই মধ্যে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে একটি নতুন সামরিক করিডোর স্থাপনের কাজ শুরু করেছে ইসরায়েল। তারা এর নাম দিয়েছে ‘মোরাগ করিডোর’। ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অর্ধশত নিহত হয়েছে। এদিকে দুই ব্রিটিশ এমপিকে ইসরায়েলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে ব্রিটেনেই ফেরত পাঠানো হয়।
রাফা এখন বসবাসের অযোগ্য
দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় মানবিক বিপর্যয় এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে। এই হামলা সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনের ওপর সব দিক থেকেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস। এক বিবৃতিতে অফিসটি জানায়, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ‘নিরাপত্তাহীন বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অবকাঠামো, গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা এবং আবাসিক বাড়িগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে।’ তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী রাফাহ শহরের ৯০ শতাংশেরও বেশি বাড়িঘর, ২৪টি পানির কূপের মধ্যে ২২টি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ৮৫ শতাংশেরও বেশি এবং আটটি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। এছাড়া সেখানকার ১২টি চিকিৎসা কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে গেছে।
কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি জানিয়েছেন, রাফাহ ও খান ইউনিসের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থান নেওয়া ইসরায়েলি সেনারা যে কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। তিনি ঐ এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করছেন। খোদারি বলেন, এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের জন্য একমাত্র খোলা পথ হলো উপকূলীয় রাস্তার আল-রাশিদ করিডোর। অর্থাৎ আরো বেশি ফিলিস্তিনিকে খান ইউনিস ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং ইসরায়েল আরো বেশি ভূমি দখলের চেষ্টা করছে।
এদিকে হামলার মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ গাজার ভেতরে নতুন করে একটি ‘নিরাপত্তা করিডোর’ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এরইমধ্যে তারা দক্ষিণের রাফা শহরকে বাকি গাজা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ‘মোরাগ করিডর’ বা সামরিক করিডোর স্থাপন করে। ইসরায়েলের গণমাধ্যমে প্রকাশিত মানচিত্র অনুসারে, করিডোরটি গাজার পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহ গত বুধবার নতুন এই করিডরের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, এটি রাফা শহরকে গাজার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, মোরাগ ছিল একটি ইহুদি বসতি, যা রাফাহ ও খান ইউনিসের মাঝামাঝি অবস্থান করত। নেতানিয়াহু ইঙ্গিত দিয়েছেন, করিডোরটি এই দুই শহরের মধ্য দিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই করিডোর নির্মাণ গাজার ভূখণ্ড ভাগ করে ফেলার একটি পরিকল্পিত কৌশল, যা মানবিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। এদিকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি গণহত্যা ও ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাকস্বাধীনতার ওপর দমনপীড়নের প্রতিবাদে হোয়াইট হাউজের সামনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। অন্যদিকে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে আজ সোমবার বিশ্বব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল অ্যান্ড ইসলামিক ফোর্সেস গ্রুপ। গাজার ভয়াবহ দৃশ্য ও নিহতের সংখ্যা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে এই ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মীদের হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলের ভুল স্বীকার
গত ২৩ মার্চ গাজায় ১৫ জন জরুরি সেবাকর্মী হত্যার বিষয়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাদের সৈন্যদের ভুল স্বীকার করেছে। ঘটনার দিন রাফার কাছে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) একটি অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘের একটি গাড়ি এবং গাজার সিভিল ডিফেন্সের একটি অগ্নিনির্বাপক ট্রাকের বহরের ওপর ইসরায়েলের সৈন্যরা গুলি চালায়। সেনাবাহিনী শুরুতে দাবি করেছিল, অন্ধকারে হেডলাইট বা ফ্ল্যাশিং লাইট ছাড়া গাড়ি বহরটির গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তারা গুলি চালিয়েছিল। আর গাড়িগুলোর চলাচলের বিষয়ে আগে থেকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি বা তাদের জানানো হয়নি। সর্বশেষ নিহত প্যারামেডিকদের একজনের তোলা মোবাইল ফোনের ফুটেজে দেখা গেছে যে, আহতদের সাহায্য করার জন্য ডাকাডাকির সময় যানবাহনগুলোতে আলো জ্বালানো ছিল। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী আইডিএফ দাবি করেছিল, নিহতদের মধ্যে অন্তত ছয় জন হামাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যদিও নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দেয়নি আইডিএফ। সেই সঙ্গে আইডিএফ স্বীকার করেছে, সৈন্যরা গুলি চালানোর সময় গাড়ি বহরে থাকা মানুষেরা নিরস্ত্র ছিলেন।
এমপি আটকে ক্ষুব্ধ ব্রিটেন
ইসরায়েলে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি দুই ব্রিটিশ এমপিকে। বিমানবন্দরেই আটক করা হয় ইউন ইয়ং এবং আবতিসাম মোহাম্মদ নামে দুই এমপিকে। পরের বিমানেই তাদের ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ব্রিটেন এবং ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক। ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।
সূত্র: আলজাজিরা ও বিবিসি